Last Updated on February 2, 2025 by কর্মসংস্থান ব্যুরো
সরস্বতী পুজো, যাকে আমরা বাগদেবীর পুজো হিসেবেও জানি, বাঙালি হিন্দুদের কাছে এক অত্যন্ত পবিত্র ও আনন্দদায়ক উৎসব। প্রতি বছর পঞ্জিকা অনুসারে মাঘ মাসের শুদ্ধ চতুর্দশী তিথিতে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়, যা বিশেষত শিক্ষার্থী, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী এবং সঙ্গীত-নৃত্য শিল্পীদের কাছে এক মহান উৎসব হিসেবে পালিত হয়। এই বছরও সরস্বতী পুজো চলে এসেছে, এবং তাই আমরা আলোচনা করব পুজোর সঠিক নিয়মাবলী, মন্ত্র এবং কীভাবে সঠিকভাবে পুজো করা উচিত।
সরস্বতী পুজোর নিয়ম: কীভাবে করবেন পুজো
সরস্বতী পুজোর দিন সকালে স্নান সেরে, সাদা বা অন্য কোনো শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করার পর, কিছু বিশেষ নিয়ম অনুসরণ করা উচিত। পুজো শুরু করার আগে শরীর ও মনকে শুদ্ধ করার জন্য এদিন নিম ও হলুদ বাটা মাখার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এতে শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক শুদ্ধিও ঘটে, যা পুজোর মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ বিদ্যার দেবী সরস্বতীর কাছে মঙ্গল কামনার সঙ্গে সম্পর্কিত।
পুজোর স্থান প্রস্তুত করার জন্য, একটি সাদা কাপড় বিছিয়ে তার ওপর সরস্বতী মূর্তি স্থাপন করতে হয়। মূর্তির সামনে একটি জলভর্তি ঘট রাখুন এবং তার ওপর আম্রপত্র ও পান পাতা রাখার রীতি রয়েছে। এছাড়া, পুজোস্থলে হলুদ, কুমকুম, চাল এবং সাদা ও বাসন্তী রঙের ফুল-মালা দিয়ে সাজিয়ে রাখুন। সেগুলির মধ্যে কুল, যা সরস্বতী পুজোর প্রধান ফল, রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, সরস্বতী পুজোর আগের দিন কুল খাওয়ার নিয়ম নেই, পুজোর পরই কুল খাওয়া হয়। মূর্তির পাশে দোয়াত, খাগের কলম ও বই রাখা উচিত। বিশেষ করে যারা সঙ্গীত বা নৃত্যশিল্পী, তারা তাদের শিল্পের উপকরণও মূর্তির কাছে রাখতে পারেন। এর পর, সরস্বতী পুজোর মন্ত্রপাঠ করতে হবে এবং দেবীকে ভোগ নিবেদন করে পুজো শেষ করতে হবে।
Saraswati Vandana
সরস্বতী পুজোকে আরও শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ করতে, মন্ত্রপাঠের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রের মধ্যে দেবী সরস্বতীর গুণগান করা হয়, যা তাঁর দয়া এবং আশীর্বাদ লাভের জন্য অপরিহার্য। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রের মধ্যে অন্যতম হলো:
স্তব: “শ্বেতপদ্মাসনাদেবী শ্বেতপুষ্পোজশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা।
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা।
বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈরচ্চৈর্তা দেবদানবৈঃ।
পূজিতা মুনিভিঃ সর্ব্বৈঋষিভিঃ সদা।”
এই মন্ত্রটি সরস্বতী দেবীর শ্বেতবর্ণ, তাঁর অলঙ্কার এবং সান্নিধ্য নিয়ে আলোচনা করে, যা আমাদের শুদ্ধতা ও জ্ঞান অর্জনের পথে সহায়ক হয়।
পুষ্পাঞ্জলি: “ঔঁ ভদ্রকালৈ নমো নিত্যং সরস্বতৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদান্ত বেদাঙ্গ-বিদ্যাস্থানেভ্যঃ এব চ।
এষ স-চন্দন বিল্বপত্র পুষ্পাঞ্জলি ঔঁ ঐং শ্রী শ্রী সরস্বতৈ নমঃ।”
পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রটি সরস্বতী দেবীর কাছে শ্রদ্ধা নিবেদন করার এক বিশেষ রীতি, যা পুজোর পরিপূর্ণতা নিশ্চিত করে।
প্রার্থনা: “ওম যা কুন্দেন্দু তুষারহারধবলা যা শ্বেতপদ্মাসনা,
যা বীণাধর-দণ্ড মণ্ডিতভূজা যা শুভ্রাবস্ত্রাবৃতা।
যা ব্রহ্মচ্যুত-শঙ্কর-প্রভৃতিভিদেবৈঃ সদা বন্দিতা।
সা মাং পাতু সরস্বতী ভগবতী নিঃশেষ জাড্যাপহা।”
এই প্রার্থনায় সরস্বতী দেবীকে বিদ্যা ও জ্ঞান দানের জন্য প্রার্থনা করা হয়, যাতে তিনি আমাদের জীবন থেকে অজ্ঞতা দূর করে মেধা ও বুদ্ধি প্রদান করেন।
সরস্বতী পুজোর বিশেষ বিধি: বিভিন্ন শুদ্ধি ও উপাদান
পুজোতে কয়েকটি বিশেষ শুদ্ধি ও নিয়ম পালন করা হয়। জলশুদ্ধি, করশুদ্ধি, আসনশুদ্ধি, পুষ্পশুদ্ধি—এই সমস্ত নিয়ম পুজোকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে সহায়ক হয়। জলশুদ্ধির মাধ্যমে পূজা স্থানের জলকে শুদ্ধ করা হয়, আসনশুদ্ধি প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে আসন তৈরি করা হয়, পুষ্পশুদ্ধির মাধ্যমে ফুলের শুদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া, পুজো শুরুর আগে সঙ্কল্প গ্রহণ করা এবং দ্বারদেবতা পুজো করা গুরুত্বপূর্ণ।
সরস্বতী পুজোর বিশেষ দিক: শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা
সরস্বতী পুজো শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক উৎসবও বটে। পুজো শুধুমাত্র দেবী সরস্বতীকে আরাধনা করা নয়, এটি আমাদের বিদ্যা, শিল্প, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। মূর্তির কাছে বই, খাতা, কলম রাখা, সঙ্গীত বা নৃত্যশিল্পীদের জন্য তাদের শিল্পের উপকরণ রাখা—এই সমস্ত কাজ সরস্বতী পুজোর বিশেষ দিক, যা আমাদের বিদ্যার প্রতি শ্রদ্ধা এবং তার চর্চার অঙ্গীকার প্রকাশ করে।